top of page

লিডার                

অমর চট্টোপাধ্যায়

 

ছেলেটা সাঁতার দিতে জানেনা গাছেও চড়তে পারে না। জামীর ওর খুব ভালো বন্ধু । পাশের ফ্ল‍্যাটে থাকে। পরপর চারটে তিনতলা ফ্ল‍্যাট কোম্পানির। ফর্সা গাট্টাগোট্টা চেহারা জামীরের। বন্ধু উল্টোবাগের রোগা শরীর । জামীর পড়ে আসানসোলে কনভেন্টে আর বন্ধু পড়ে বার্ণপুর মাল্টিপারপাসে। দুজনেই সিক্সের ছাত্র , দুজনেরই সকালে স্কুল।  স্কুল থেকে ফিরে সময় পায় না ।  ডিউটি থেকে বাবা চলে আসেন বারোটায়।  দেড় ঘন্টার খাবার ছুটি। দেড়টায় ফিরে যেতে হয় ডিউটিতে।  দুপুরে সবাইকে একসাথে বসে খেতে হয়, এটাই এবাড়ির রেওয়াজ। কাজে কাজেই যেভাবেই হোক বারোটার মধ‍্যে স্নান টান করে তৈরী থাকতে হবে।   সেদিন স্কুল ছুটি দুজনেরই। কোম্পানির গাড়ি চলে গেছে বাবাকে নিয়ে। সকাল সারে সাতটায় টিফিন করে তৈরী থাকতে হয়। একসাথে টিফিন করে গুডিবয়ের মত পড়তে বসে গেছে সে। মন দিয়েই পড়ছিল হঠাৎ বাঁশির আওয়াজ । একবার‌ই।  এ বাঁশি তো চেনা ! তালপাতার দুটো ছোট্ট টুকরো ঠোঁটে আটকে ভারি সুন্দর আওয়াজ করে জামীর । চঞ্চল হল মন, আর পড়া হবেই না। ও জানে জানালা দিয়ে কাউকে দেখা যাবে না, ধরা দেবে না জামীর। সঙ্কেত তো চেনা। ব‌ই উল্টে উঠে পরল ছেলেটা। ছোট ছোট পায়ে এ ঘর ও ঘর ঘুরে পেছনের লোহার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো তরতর করে।  দেখা হতেই জামীর বলে --  " গুলতি কোথায় ?"  " পকেটে। "  " গুলি? "  " পকেটে! "  " চল্ "  " কোথায়? "  " ফলো মি "। জামীর মাঝোমধ‍্যে লিডার হয়ে যায়। তখন আদেশের স্বর শোনা যায়। মিলিটারী ভঙ্গি ফুটে ওঠে ওর চলায়, কথা বলায়। চলেছে ছেলে বন্ধুর পিছে পিছে।  বারি ময়দান পিছে ফেলে জামীর বাঁক নিল সুভাষপল্লীর দিকে।  " আরে কোথায় যাব বল তো ?" জোরেই হয়েছে কথাগুলো।  জামীর দাঁড়িয়ে পরলো। ছেলেটার হাত ধরে রাস্তার ধারে টেনে নিল।  " মামি কাল আমাকে নিয়ে দোস্তের বাড়ি গেছিল। বড় বাগান, অনেক আমরুৎ!"    " ওখানে যাবি? দেখতে পেলে তোর মাম্মিকে বলে দেবে। তখন?"  " সে তখন দেখা যাবে। ডরপুক কাঁহিকে।"  একেবারে আঁতে ঘা! ভীতুর বদনাম কেউ আমাকে দিতে পারবে না।  একা একা চলে যাই শ্মশানে, সাঁতার জানিনা কিন্তু সাঁতার শেখাই যে চায়, গাছে উঠতে জানিনা গুলতি চালাই। অজান্তেই প‍্যান্টের দুই পকেটে হাত চলে গেল। ডাইনে গুলতি ,বাঁয়ে গুলি  -এঁটেল মাটি গোল গোল করে শুকিয়ে নেওয়া।  মগডালের পেয়ারা এক টিপে নামাতে পারি আমি। গাছে চড়ার দরকার হয় না।  হাঁটার গতি বাড়ল। বেশ বড় বাগান । বাড়িটাও অনেকখানি জায়গা নিয়ে।  আশপাশের বাড়িগুলো গায়েগায়ে নয় সকলের কিছুটা করে ফাঁকা জায়গা আছে ।  বাগানটা ভর্তি আম, জামরুল আর পেয়ারা গাছ।  এমন বাগানে লোভ লাগে, গাছগুলোর কেমন যেন টান্।  পাচিলের বাইরে একটা নিরালা কোনে গিয়ে দাঁড়াল দুজনে। চুপচাপ । শব্দ শুনে বোঝার চেষ্টা কাছেধারে কেউ আছে কিনা। না, মনে হচ্ছে সব শুনশান। জামীরের কাঁধে পা রেখে পাঁচিলের ওপরে থুতনি তুলে দিল ছেলেটা। না, কাউকে দেখা যায় না। বাঁয়ে বাগানের শেষে দোতলা বাড়ি। জানালাগুলো অবশ‍্য খোলা। এই জন‍্য এসব কাজ শীতেই সুবিধে। ফেব্রুয়ারির শেষে জানালা তো খোলা থাকবেই। মুখোমুখি দেখা যাচ্ছে একটা ছোট মত ঘর , বোধহয় মালি থাকে। দরজা জানলা বন্ধ।  মাথা ঝুঁকিয়ে রিপোর্ট করতে হল জামীরকে। নির্দেশ এলো --  " অন্দর যা "।  নিজের শরীরটা সম্পুর্ণ ঝুলিয়ে দিয়ে ছেলেটা টুপ করে নেমে পরলো ভেতরে। পরক্ষনেই জামীর ঝুপ করে নেমে এলো।  দুজনেই স্ট‍্যাচু হয়ে র‌ইল কিছু সময়। দেখতে হবে এই আওয়াজে কেউ সজাগ হ'ল কিনা! এখানে সব জামরুল গাছ, পেয়ারা গাছগুলো মালির ঘরের দিকে । দুজনে প‍্যান্টের ভেতর জামা গুঁজে নিল যাতে পেয়ারাগুলো জামার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে পারে। নিঃশব্দে এগিয়ে চলল পেয়ারার সন্ধানে  সজাগ শিকারীর মত পায়ে পায়ে। জামীর দাঁড়াল একসময়। আঙ্গুল দিয়ে একটা আধপাকা ফল দেখাল। ছেলেটা গুলতি তাক করল -- ফল পড়ল নীচে ।  এভাবে দশ বারোটা পেয়ারা নামানোর পরে দুজনে সেগুলো জামার ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। আবার শুরু হল এক‌ই ভাবে। হঠাৎ একটা কাক তারস্বরে ডেকে উঠল । দেখাদেখি আর একটা, আর একটা, আর‌ও আর‌ও আর‌ও। দেখতে দেখতে পনেরো কুড়িটা কাক চিৎকার জুড়ে দিল মাথার ওপর। বিপদ !! জামীর বলল -  " তুই কাকের বাসায় গুলি করেছিস, বাচ্চা মরেছে। জলদি ভাগ।"  বলতে বলতেই মালির দরজা খুলে গেল, দোতলা বাড়ি থেকে দুজন মহিলা বাইরে এসে চিৎকার জুড়েছে -  " চোর চোর , পাকড়ো পাকড়ো-- "!    কাঠবেড়ালীর মত পাঁচিল বেয়ে উঠে পড়ল জামীর, ঝাঁপিয়ে পড়ল বাইরে। ছেলেটাও উঠল বটে কিন্তু ঝুলে থাকা একটা পা ধরে ফেলেছে মালি। শুরু হল টানাটানি। দেয়ালের ঘষায় ছড়ে যাচ্ছে হাত! মলি এবার পা ছেড়ে দিয়ে প‍্যান্ট ধরে টানতে লাগল। বিপদ! পালাতে হলে প‍্যান্ট মালির জিম্মা করে পালাতে হয়! সেটা কি করে সম্ভব ?  এতটা রাস্তা যাবে কী করে ?  অগত‍্যা ধরা পড়তে হল।  দেহাতি লোকটা তো এই মারে কি সেই মারে। অনর্গল দেহাতিতে গালাগালি দিতে দিতে প্রায় ছেঁচড়ে নিয়ে গেল মহিলাদের কাছে ।  চোরকে হাতে পেয়ে তারাও বেশ উত্তজিত!  পেয়ারা চোরের তখন গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। এখানে যদি এরা আটকে রাখে ?  যদি বাবা জানতে পারে তখন কি হবে ?  " ছেড়ে দাও আমাকে ছেড়ে দাও। আর কোনদিন তোমাদের বাগানে ঢুকব না গো---"  ভবি কিন্তু ভোলে না।  এমন সময় তীর বেগে দৌড়ে ঢুকলো জামীর। ডান হাতে ফুট তিনের একটা কঞ্চি।  " ছোড় দো ,হামারা দোস্তকো ছোড় দো- নহি তো--"    বলতে বলতে কঞ্চিটাকে  তলোয়ারের মত এগিয়ে ধরল মালির পেটের সামনে। বাঁ হাত ডান হাতের সমান্তরালে পেছনে তোলা। ডান পা আগে বাঁ পা পেছনে । ঠিক যেন তলোয়ার বা ক্রিচ্ ফাইটের জন‍্য মালিকে আহ্বান জানাচ্ছ।  আবার আদেশ    " শুনা আপনে ? মেরা দোস্তকো আভি ছোড় দো !"  একজন মহিলা চেঁচিয়ে উঠলো-  " আরে, আপ ?  জুনমকো বেটা হো না আপ ?"    জামীরের কোন ভাবান্তর নেই।  চোখ মুখ ফেটে পড়ছে যেন।   "আপ মুঝসে মাঙ্গা কিঁউ  নেহি , দো পাঁচ দে দেতে !"  ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে। থমথমে গলায় বলল -  " হামলোগ ভিক্ নহি মাঙতে।  মেরা দোস্তকো কোই কশুর নহি ।  ডাঁটনা হ‍্যায় তো মুঝে ডাঁটো ।" ফাইটের ভঙ্গিতে একটুও ঢিলেমি নেই । এক আছে সবসময় ।  মালকিনের ইশারায় হাত ছেড়ে মালি ফিরে গেল কাজে।  প্রায় সাথে সাথেই কঞ্চি ছুঁড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ঘুরে গেল জামীর। নির্দেশ এলো -  " ফলো মি। "  একদম মিলিটারি কায়দায় আমাকে নিয়ে গটগট করে বেড়িয়ে এলো ।  পেছন থেকে আওয়াজ এলো " জুনমকো আনে বোলনা বেটা।"    ফিরেও দেখলো না জামীর।।সেদিনের সেই বন্ধু এখন কেমন আছে আমি জানিনা।

সংযোগসূত্র সার্ভে টিম

ফিল্ড ইন্সট্রাক্টরঃ বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত

ফিল্ডবুক রাইটারঃ সমীর ভট্টাচার্য

ফিল্ড সুপারভাইজারঃ রামচন্দ্র ঘোষ ও আশীষ সরকার

bottom of page