top of page

দিন যাপন 

অপূর্ব দাশগুপ্ত

রাতে আমি ভালোই ঘুমিয়েছি। তবু আরো কিছুটা ঘুম হলে সকালের অনেকটা সময় কেটে যেত। রাত সাড়ে এগারোটায় শুয়েছি কাল, মোবাইলে রবীন্দ্র সংগীত চালিয়ে। ৩৫ ডিগ্রি ছিল পারদ, প্রথম গানটা ছিল বর্ষার, সঘন গহন রাত্রি, হেমন্তের কণ্ঠে। পরের গানটা মনে পড়ছেনা, ওটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি। মাইল্ড ঘুমের ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার।

 

হায়, ঘুম ভেঙে গেল কেন ভোর ভোর। দেয়াল ঘড়িটা মাথার পেছনের দেওয়ালে। শোয়া থেকে বসতে হবে, যদি ঘড়ি দেখতে হয়। দেখে কী দরকার বরং বিছানায় পড়ে থাকি আরো কিছুটা সময়। আমার আজকের কাজ যে কোরে হোক আবার রাত্রি সাড়ে এগারোটা বাজানো।

 

শুয়ে শুয়ে পুরনো পরিচিত মুখ মনে করি  বরং,  যাদের দেখি না বহুদিন, সময় কাটবে।

আমাদের অনার্স ক্লাসে একটি মেয়ে ছিল না, সে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে ক্লাস করতো, আমাদের চেয়ে কিছুটা সিনিয়র। স্যার আমাদের নাম ডাকা হলে, শেষে তার নাম ডাকতেন, ‘স্পেশাল নাইন’? সে বলতো ‘প্রেজেন্ট প্লিজ।’ 

 

সে কারণে আমরাও তাকে ডাকতাম স্পেশাল নাইন বলে। সে খুব সাধারণ মেয়ে ছিল, স্পেশাল কিছুই ছিল না, কলেজ শেষ করে এম এ পড়ে সময় নষ্টও করেনি। তাকে কলেজের পর আর দেখিনি, সময় করে তার কথা মনেও করিনি। আজ যখন বুঝেছি বেশিরভাগ সময়ে চটকহীনদের মধ্যেই স্পেশাল কিছু থাকে, তখন স্পেশাল নাইনকে নিয়ে কিছুটা সময় কাটালাম।

 

তারপর ভাবলাম বিশুর কথা। সে কেমন ফোন ধরে অনেকটা সময় নিয়ে তারপর ধীরে হ্যালো বলে, ছোট বেলার বিচ্ছু, এমন ব্যক্তিত্ব পায় কী করে? সাকসেস মানেই কি উঁচু ব্যক্তিত্ব ?

 

এই বিশুই বলেছিলো সকালে উঠে ধ্যানে বসবি, তারপর ফ্রি হ্যান্ড আধঘন্টা। ধ্যানে বসি। মনকে চিন্তাহীন করতে হবে। সেই প্রচেষ্টাতে সফল হতে গিয়ে নানা চিন্তায় ডুবে যাই। উদ্ভট সব ভাবনা মনকে ঘেরাও করে। 

 

এমন সময় বেল বাজে, খবরের কাগজ দিয়ে গেল। কাল থেকে না হয় ফ্রি হ্যান্ড হবে, ধ্যান আজ এটুকুই থাক, এখন পেপার পড়ে এগিয়ে থাকার টাইম।

 

 প্রথমেই শেষ পাতায় যাই। কাল ইন্ডিয়ার খেলা ছিল, দেখা হয়নি, বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। শেষ পাতায় গিয়ে দেখি খেলা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। অগত্যা ভয়ে ভয়ে প্রথম পাতা, কি দেখবো? খুন  না স্ক্যাম? ধর্ষণ না মৃত্যু? আগুন না বন্যা, নাকি বোমায় বালক উড়ে গেল । মাঝের পাতায় পোস্ট এডিটরিয়ালখানা ভালো আজ , তবে ভালো জিনিস না পড়ে তুলে রাখতে হয়। 

 

আট টা বাজে। আমার পরিচারিকা আসবেন সাড়ে নটায়। চা ভেজাই গরম জলে।চা পাতারা জলে টান টান হয়।তিনি এলে তবে ব্রেকফাস্ট, তাই সময় কাটাতে চা খেয়েই আমিও ফের বিছানায় টান হই ,ঘরে এখনো কিছু ঠান্ডা অবশিষ্ট আছে, অবশিষ্ট আছে ওষুধ-জনিত ঘুমের নেশা।

 

দাদা, চাউমিন করে দেই আজ? 

না না তোমার চাউমিনে বড্ড তেল। রুটি কর আর সঙ্গে আলু কুমড়োর চর্চরি। ফলটল কেটো না আবার। শুধু দুধ চা। দিদি ফোন করলে বলবে, ওটস আর হেলথ ড্রিংক্স খেয়েছি।

 

 স্নানের আগে কিছু ফোন আসে, যায়। স্মৃতিচারণেও ক্লান্তি আসে এক সময়। অত:পর গান শুনি। একটা আরামদায়ক বুড়োদের আধুনিক ইজি চেয়ার কিনেছি, তাতে বসে (বা শুয়ে) আজ সলিল চৌধুরীর সুর দেওয়া গান শুনি। সুদূর অতীত হানা দেয় লতা মোঙ্গেসকরের গলায়। আরে ছোটবেলায় যখন শুনতাম, গানের কথাগুলি মন দিয়ে শুনিনিতো। এখন  চেনা সুরের আধ-চেনা কথাগুলি মন দিয়ে শুনি।

 

খেয়ে দেয়ে দুপুরে ঘুমোতে নেই। ঘুমোতে হবেও না। কদিন ধরে দুপুরে ‘জলের উপর পানি’ বইটি মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়ছি। কি অসাধারণ লেখা। একসময় কফি হাউসের তিন তলায় অমরদার সভাপতিত্বে নবীন লেখকদের গল্প পাঠের আসর বসাতাম। এই গুণী লেখক দুয়েকবার এসেছেন, অতিথি হয়ে, মাঝে মাঝে দুয়েক কথায় পরামর্শ দিয়েছেন নতুন লেখকদের।কুন্ঠাবসত তাঁর সঙ্গে আলাপ করিনি। 

 

অজগর সাপের শ্লথ গতিতে বিকেল কাটে।তারপর একসময় সন্ধ্যা নেমে আমার ছাদের কার্নিসে এসে পা ঝুলিয়ে বসে। আমি আমার ঘরে বসে দেখি তার কালো থামের মত পা-গুলি দিয়ে সে আমার জানালায় কালি বুলিয়ে দিয়ে গেল । এই সময়টা বড়োই মন খারাপের। বাইরের গাছ-বাড়ি-আকাশ, সব বিষাদের সুর বিস্তার করছে। কিন্তু না, এ সন্ধ্যার দোষ নয়, এ আমার অনুভবের দোষ। সন্ধ্যার ঘাড়ে দোষ চাপানো আসলে আমার অন্যের ঘাড়ে দোষ  চাপানোর স্বভাব-দোষ।

 

  টি ভি খুলবো কি? না থাক,  সেখানে কোন মন্দ ননদ ভালো বৌমার রান্না মাংসে নুন মিশিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার আমাকে ৫ মিনিটের মধ্যে খবর শুনে ঝাড়পিটের সিনেমা দেখতে বলেছে, নইলে তাঁকে প্রেসারের ওষুধ লিখতে হবে।

 

আমি টিভি খুলে ইউ টিউবে ‘খণ্ডহর’ ছবিটা দেখি। এতদিন পরে আজও ছবিটা ভালো লাগলো। শেষ দৃশ্যে নাসিরউদ্দীন আবার শহরে ফিরে ষ্টুডিওতে কাজে ব্যস্ত, পেছনের দেয়ালে খণ্ডহরে দাঁড়িয়ে শাবানার ছবিটা। আগেরবার মনে হয়নি,  এবার মনে হল, নাসির দুয়েক দিনের মধ্যে সেই পরিত্যাক্ত গ্রামে ফিরে শাবানা আর তাঁর অসুস্থ মায়ের দায়িত্ব নেবে ঠিক।

 

রাতে খাবার গরম করে খাই। মেয়ের ফোন আসে।দরজা দিয়েছো? গ্যাস নেভালে? ওষুধ? তাঁকে চিন্তামুক্ত করে আমি ভাবি আজ থেকে ঘুমের ওষুধ বাদ দেব, খুব ক্ষতিকর।আরেকটা ঘুমের ওষুধ আমি জানি– কঠিন একটা বই নিয়ে শুয়ে পর, শুয়ে শুয়ে পড়, ঘুম আসা অনিবার্য। আমি অবশ্য দুটোই প্রয়োগ করলাম আজ।

 

দিনটা খুব ভালো কাটলো। প্লামবার, ইলেকট্রিসিয়ান, এদের ডাকতে হয়নি, সিলিন্ডার পাল্টাতে হয়নি,অযথা কলিংবেল বাজেনি, কোন দুসংবাদ পাইনি। আর কি চাই জীবনে। সাড়ে এগারোটা বাজালো।

 

অপূর্ব দাশগুপ্ত।

সংযোগসূত্র সার্ভে টিম

ফিল্ড ইন্সট্রাক্টরঃ বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত

ফিল্ডবুক রাইটারঃ সমীর ভট্টাচার্য

ফিল্ড সুপারভাইজারঃ রামচন্দ্র ঘোষ ও আশীষ সরকার

bottom of page